অপরাধ

গত ছয় মাসে ৭৪ জন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী দুর্নীতির অভিযোগে আইনের আওতায় আনা হয়েছে

  প্রতিনিধি ২০ জুন ২০২৫ , ৩:৫০:০৫ প্রিন্ট সংস্করণ

গত ছয় মাসে দেশের প্রশাসন, বিচার বিভাগ, রাজউক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচন কমিশন, রেল, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর অন্তত ৭৪ জন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী দুর্নীতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় এসেছে। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সচিব, বিচারক, প্রকৌশলী, কর কমিশনার, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এমনকি একটি রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও।দুর্নীতির বলয়ে আটকে পড়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই এবার জোরালো অবস্থান নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি দুদকের মামলায়, চার্জশিটে এবং তদন্তে উঠে এসেছে অন্তত ৭৪ জন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নাম। যাদের অধিকাংশই ছিলেন প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বে।

দুদকের অভিযোগপত্র ও প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এ প্লট বরাদ্দে জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিয়া, সাবেক সদস্য মো. খুরশিদ আলম, তন্ময় দাস, মো. নাসির উদ্দিন, মেজর (অব.) শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াসি উদ্দিন, সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার ও অতিরিক্ত সচিব মো. অলিউল্লাহর বিরুদ্ধে।

ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-এর শীর্ষ কর্তাদের বিরুদ্ধে ৬৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চাঞ্চল্যকর মামলা করেছে কমিশন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর আহমেদ মিশুক, নির্বাহী পরিচালক ও নমিনি পরিচালক সাফায়েত আলম, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল হক, সিনিয়র ম্যানেজার মারুফুল ইসলাম ঝলক, চিফ টেকনোলজি অফিসার আবু রায়হান, হেড অব ফাইন্যান্স অপারেশন রাকিবুল ইসলাম, চিফ ফাইন্যান্স অফিসার আফজাল আহমেদ, চিফ কমার্শিয়াল অফিসার শিহাব উদ্দিন চৌধুরী এবং হেড অব বিজনেস ইন্টেলিজেন্স গোলাম মর্তুজা চৌধুরীর নাম রয়েছে এতে।

একের পর এক ঘটনায় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কেবল প্রশাসন বা আর্থিক খাত নয়, দেশের বিচার বিভাগও দুর্নীতির ছায়া থেকে মুক্ত নয়। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ১৫ জন বিচারকের তথ্য চেয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। এই তালিকায় রয়েছেন সাবেক যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) ও সিনিয়র জেলা জজ বিকাশ কুমার সাহা, ঢাকার সাবেক মুখ্য মহানগর হাকিম রেজাউল করিম চৌধুরী, অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূর, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক শেখ গোলাম মাহবুব, মাহবুবুর রহমান সরকার, সাবেক জেলা জজ মনির কামাল, সাবেক অতিরিক্ত সিএমএম তোফাজ্জল হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা জজ মুশফিকুর ইসলাম, সাবেক সিএমএম কাইসারুল ইসলাম, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা সাইফুল আলম, জেলা জজ ফারহানা ফেরদৌস, কামরুন নাহার রুমি, গৌরাঙ্গ হোসেন, মোহাম্মদ এরফান উল্লাহ এবং সাইফুল আলম চৌধুরী।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছাত্র প্রতিনিধি তুহিন ফারাবি এবং মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
বড় অঙ্কের কর ফাঁকির অভিযোগে আলোচনায় এসেছে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে আগের আওয়ামী লীগ সরকারের চুক্তি। এই চুক্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পাশ কাটিয়ে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে দুদকের দাবি। এতে তৎকালীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব এবং পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আহমদ কায়কাউসসহ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ট্যাক্সেস অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সাবেক সদস্য রঞ্জিত কুমার তালুকদার এবং তার স্ত্রী ঝুমুর মজুমদারের বিরুদ্ধে ১১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছে দুদক। একই ধরনের অভিযোগে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে।

প্রশাসনিক দুর্নীতির আরও এক চিত্র উঠে এসেছে শিক্ষাখাত থেকে, যেখানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এবং আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক সভাপতি আবু হেনা মোরশেদ ভর্তিকাণ্ডে দুর্নীতির কারণে দুদকের ফাঁদে পড়েছেন। মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে জ্ঞাত-আয়ের বাইরে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। টাঙ্গাইলে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেও বিল উত্তোলনের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম, সাবেক উপজেলা প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম খান এবং মো. মাইনুল হক।

বাগেরহাটে দুই ভারতীয় নাগরিককে অবৈধভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদান করার ঘটনায় দায়ী করা হয়েছে তৎকালীন নির্বাচন কর্মকর্তা এবং বর্তমানে বরিশাল আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা দিলীপ কুমার হাওলাদার এবং সাবেক সেনা সদস্য মো. মোশাররফ হোসেন মোল্লাকে।

পিরোজপুরে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের চার কর্মকর্তা— মো. মোহাসীন, মো. মাসুম হাওলাদার, নজরুল ইসলাম, মো. আলমগীর হাসান এবং এলজিইডি অফিসের হিসাবরক্ষক একেএম মোজাম্মেল হক খানের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গোপালগঞ্জে জেলা পরিষদের একটি সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে মামলার মুখে পড়েছেন সাবেক সহকারী প্রকৌশলী আনিচুর রহমান।

রেল খাতেও দুর্নীতি থেমে থাকেনি। পাহাড়তলী কার্যালয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ফরিদ আহমেদসহ ১০ জন কর্মকর্তা রেলের যন্ত্রাংশ ক্রয়ের নামে ভুয়া রেকর্ডপত্র তৈরি করে ১ কোটি ৬২ লাখ টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের জালে ধরা পড়েছেন। ঢাকার কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চলের কর কমিশনার গনেশ চন্দ্র মণ্ডলের নামও যুক্ত হয়েছে দুদকের তদন্ত তালিকায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি এখন আর নির্দিষ্ট কোনো বিভাগ বা স্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারক ব্যক্তিরা পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েছেন এ ঘুণে ধরা ব্যবস্থায়। ঘুষ নিচ্ছেন খোদ দুদক কর্মকর্তারাও।

গত ফেব্রুয়ারিতে পরিচালিত বিবিএস জরিপ অনুযায়ী, দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সেবা পেতেও ঘুষ দিতে হয়েছে নাগরিকদের। দুদকের সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়েছে এমন স্বীকারোক্তি এসেছে ১.৯৯ শতাংশ নাগরিকের কাছ থেকে।

সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস)-২০২৫ এর প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে বিভিন্ন সরকারি দফতরে সেবা নেওয়ার সময় অন্তত ২১ ধরনের দফতরে ঘুষ লেনদেনের অভিজ্ঞতা হয়েছে নাগরিকদের।

জরিপ অনুযায়ী, গত এক বছরে যেসব নাগরিক জনসেবা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে ৩১ শতাংশেরও বেশি ঘুষ বা দুর্নীতির সম্মুখীন হয়েছেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৩৮.৬২ শতাংশ হলেও নারীদের ক্ষেত্রে তা তুলনামূলকভাবে কমে ২২.৭১ শতাংশ।

সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিজ্ঞতা হয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সেবা নিতে গিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে সেবা নেওয়া নাগরিকদের ৬৩.২৯ শতাংশকে ঘুষ দিতে হয়েছে।

দুর্নীতির তালিকায় এরপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী (৬১.৯৪ শতাংশ), পাসপোর্ট অফিস (৫৭.৪৫ শতাংশ), ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস (৫৪.৯২ শতাংশ), বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রসিকিউটর (৫৩.৭৭ শতাংশ) এবং ভূমি রেকর্ড/অধিগ্রহণ/সেটেলমেন্ট অফিস (৫১.৪০ শতাংশ)।

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশের ৬৪টি জেলায় পরিচালিত এই জরিপে ৮ লাখ ৩১ হাজার ৮০৭ জন নাগরিকের মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ১৬-এর আওতায় নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচার ও বৈষম্য বিষয়ে নাগরিকদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরাই ছিল জরিপের মূল লক্ষ্য।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ছয় মাসে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ স্তরে যেভাবে দুর্নীতির অভিযোগে একের পর এক সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী দুদকের তদন্ত ও মামলার আওতায় এসেছেন, তা বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থার দুরবস্থা আরেকবার স্পষ্ট করে তুলেছে। শুদ্ধির যুদ্ধে এগিয়ে গেলেও, সামনে রয়েছে কঠিন সব চ্যালেঞ্জ।

দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, দুদককে নানামুখী চাপের মধ্যে থেকে শক্তিশালী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি তুলে ধরতে হচ্ছে। যদিও বিগত সরকারের তুলনায় এখন তেমন কোনো চাপ নেই। কারণ দুদকের তৎপরতাও বেড়েছে। সরকার যে সংস্কারের কথা বলছে, এটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে কাজ করা হচ্ছে, সেটাও বাস্তবতা।

আরও খবর

Sponsered content