অর্থনীতি

বেক্সিমকো গ্রুপের ৯৪টি কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ

  প্রতিনিধি ৩ জুলাই ২০২৫ , ১:৪৪:৪৬ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপের ৯৪টি কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া সালমান এফ রহমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ ৭৯ জনের বিও হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন বুধবার প্রকাশ: ৭ মে এ আদেশ দেন।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, সালমান এফ রহমান, তাঁর স্ত্রী সৈয়দ রুবাবা রহমান, ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান, সালমানের ভাই আহমেদ সোহাইল ফসিহুর রহমান, সোহাইলের ছেলে আহমেদ শাহরিয়ার হাসানের সব শেয়ার ও বিও হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
বেক্সিমকোর যে ৯৪টি কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেড, বেক্সিমকো টেক্সটাইলস লিমিটেড, বেক্সিমকো ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পার্ক, বেক্সিমকো মিডিয়া লিমিটেড, বেক্সিমকো সিনথেটিক লিমিটেড, বেক্সিমকো রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, বেক্সিমকো কেমিক্যালস লিমিটেড, বেক্সিমকো ট্রেডিং লিমিটেড, বেক্সিমকো প্রপার্টিজ লিমিটেড, বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিংস লিমিটেড, বেক্সিমকো ইনফরমেশন টেকনোলজি লিমিটেড, বেক্সিমকো ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, বেক্সিমকো গ্লোবাল লজিস্টিকস লিমিটেড, বেক্সিমকো এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড, বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেড, বেক্সিমকো এভিয়েশন লিমিটেড, বেক্সিমকো পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, বেক্সিমকো অ্যাগ্রো কেমিক্যালস লিমিটেড, বেক্সিমকো অ্যাস্ট্রো কোম্পানি লিমিটেড, বেক্সিমকো হোল্ডিংস লিমিটেড, বেক্সিমকো লজিস্টিকস লিমিটেড, বেক্সিমকো মাইনিং অ্যান্ড এনার্জি কর্পোরেশন লিমিটেড।
এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সালমান এফ রহমান, তাঁর পরিবারের সদস্য ও সহযোগীদের নামে থাকা ৩৭২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন আদালত।
দুদকের পক্ষ থেকে আজ আদালতকে জানানো হয়েছে, সালমান এফ রহমান ও অন্যদের বিরুদ্ধে প্লেসমেন্ট শেয়ার কারসাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ার হোল্ডারদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। দুদক জানতে পেরেছে, সালমান এফ রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠরা এসব ব্যাংক হিসাবের অর্থ হস্তান্তর বা স্থানান্তর করার চেষ্টা করছেন।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, অবরুদ্ধের আদেশ হওয়া ৩৭২টি ব্যাংক হিসাবের মধ্যে সালমান এফ রহমানের ৩টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। আর তাঁর ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমানের নামে দুটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। বাকিগুলো তাঁর পরিবার ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
গত ১৩ জানুয়ারি সালমান এফ রহমান, তাঁর পরিবারের সদস্য ও সহযোগীদের নামে থাকা ২৫০ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ক্রোক করা এসব সম্পদের বেশির ভাগই রয়েছে ঢাকার দোহারে।
সিআইডি বলছে, রপ্তানি–বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে ১৭টি মামলা করে সিআইডির আর্থিক দুর্নীতি দমন বিভাগ ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। এসব মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সিআইডি সালমান এফ রহমান, তাঁর ছেলে শায়ান ফজলুর রহমানসহ অন্যদের নামে দোহারে প্রায় দুই হাজার শতাংশ জমি, জমিতে নির্মিত স্থাপনা ও রাজধানীর গুলশানে একটি ফ্ল্যাটের খোঁজ পায়।
এরপর ১৩ জানুয়ারি সালমান এফ রহমান, তাঁর ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান এবং সালমানের ভাই এ এস এফ রহমান, তাঁর ছেলে আহমেদ শাহরিয়ার রহমানসহ অন্য আসামিদের নামে থাকা সম্পদের বিবরণ আদালতে তুলে ধরে ক্রোকের আবেদন করে সিআইডি। আদালত সেদিনই এসব সম্পদ ক্রোক করার আবেদন মঞ্জুর করেন। অপরাধ তদন্ত সংস্থাটি বলছে, ক্রোক করা এসব সম্পত্তির বাজারমূল্য ২৫০ কোটি টাকা।
মামলাগুলোয় সালমান এফ রহমান, তাঁর পরিবারের সদস্যসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে ৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের সম্পত্তি ক্রোকের আবেদনে সিআইডির পক্ষ থেকে জানানো হয়, আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান ও আহমেদ শাহরিয়ার রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমতি না নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আর আর গ্লোবাল ট্রেডিং ও আর আর হোল্ডিং লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। অর্থ পাচারের উদ্দেশ্যে এসব প্রতিষ্ঠান গড়েন তাঁরা।
বেক্সিমকো গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ২,০৯৫ কোটি টাকা। এর আগে, বেক্সিমকো গ্রুপের স্বনামে নেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৩,০৪২ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২,৯২৫ কোটি টাকা। তবে, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যার মধ্যে ৩১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
আরও বিস্তারিতভাবে, বেক্সিমকো গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ৩১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বেক্সিমকোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২,০৯৫ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের একটি অংশ।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
বেক্সিমকো গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২,০৯৫ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের একটি অংশ।
বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ৩১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বেক্সিমকোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২,০৯৫ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের একটি অংশ।
এই খেলাপি ঋণ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে আছে।

আলোচিত শিল্পগ্রুপ বেক্সিমকোর ব্যাংক ঋণ

২৭ মে পর্যন্ত তদন্তে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের স্বনামে ঋণ পাওয়া গেছে ৫৩ হাজার ৪২ কোটি টাকা। মোট ২৪টি ব্যাংক থেকে তিনি এসব ঋণ গ্রহণ করেছেন।
এই ঋণের মধ্যে সরকারি খাতের জনতা ব্যাংক থেকে ৪৭ শতাংশ ও সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে ২০ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার ঋণের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবিতে পাঠিয়েছে। বাকি ঋণও খেলাপিযোগ্য। অনেক ঋণের বিপরীতে জামানত নেই বলে ব্যাংকগুলো খেলাপি করেছে। কিন্তু সে তথ্য এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়নি।
কারণ গ্রাহকের ব্যবসা সচল রাখতে নতুন ঋণ দিয়ে কিছু খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছে। এর আগে বেক্সিমকোর ৫৩ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বেক্সিমকো গ্রুপের বেনামে আরও ঋণ রয়েছে। সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে।

এক ডজনের বেশি ব্যাংককে ঝুঁকিতে ফেলেছে বেক্সিমকো

নিজস্ব প্রতিবেদক:

আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী বেক্সিমকো শীর্ষ খেলাপির তকমা নিয়ে এখন বহুল আলোচিত-সমালোচিত। এই দুই গ্রুপের কারণে অন্তত এক ডজন ঋণদাতা ব্যাংক সংকটে পড়েছে, যা ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির তালিকায় দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেক্সিমকো ২৩ হাজার ১২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে তালিকার শীর্ষে ছিল।
ব্যাংকাররা জানান, বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান বর্তমানে কারাগারে ফলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব হচ্ছে না।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বেক্সিমকো মোট ১৬টি ব্যাংক ও সাতটি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে, যার মধ্যে আট ব্যাংকের কাছে ২৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
বেক্সিমকোর খেলাপির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে জনতা ও সোনালী ব্যাংক। অন্যদিকে, এস আলমের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা এবং তাদের মোট ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।

বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এখন কারাগারে। তার ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে।
দায়, দেনা, ঋণ ও মামলায় বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশোনার জন্য একজন রিসিভার নিয়োগ করতে নির্দেশনা জারি করেছে আদালত

বেক্সিমকো গ্রুপ

বেক্সিমকো গ্রুপ মূলত বাংলাদেশের এক্সপোর্ট ইমপোর্ট এবং স্টক এক্সচেঞ্জের বাজারে রাজত্ব করে আসছে। বেক্সিমকো গ্রুপে প্রায় ৬৫,০০০ কর্মী নিয়োজিত আছেন। বর্তমানে বেক্সিমকো গ্রুপের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার। পোশাক, ইঞ্জিনিয়ারিং, অনলাইন, ফুড, র্ফামা, টেলিভিশন, বিনিয়োগ, ব্যাকিং সহ আরো নানা খাতে বেক্সিমকো গ্রুপ ব্যাবসা করে আসছে। বাংলাদেশের অন্যতম টেলিভিশন চ্যানেল (ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন) বেক্সিমকো গ্রুপের।

সব কারখানা খোলা, বন্ধ হয়নি উৎপাদন
ডিএসইকে জানিয়েছে বেক্সিমকো

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বাংলাদেশের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকোর সব কারখানা খোলা রয়েছে, কোথাও উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়নি। ‘১৫টি পোশাক কারখানার ৪০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই’ সংক্রান্ত প্রকাশিত সংবাদের ব্যাখ্যায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) এ তথ্য জানিয়েছে কোম্পানিটি।
২২ ডিসেম্বর ডিএসইর এক প্রশ্নের জবাবে পরদিন এক বিবৃতিতে বেক্সিমকো বলেছে, ‘বেক্সিমকো লিমিটেড সম্পূর্ণরূপে কার্যক্রম চালু রেখেছে। প্রতিবেদনে বন্ধ হিসেবে উল্লেখিত ১৫টি পোশাক কারখানা বেক্সিমকো লিমিটেডের নয়।’ বিবৃতিটি ডিএসইর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়, গত ১৯ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে এই মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, বেক্সিমকো গ্রুপের ১৫টি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে ৪০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। বিষয়টি স্পষ্ট করতেই বেক্সিমকো ডিএসইসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে এই বিবৃতি পাঠিয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো লিমিটেড। টেক্সটাইল, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই), সিরামিকস, আইসিটি, রিয়েল এস্টেট, সামুদ্রিক খাদ্য এবং পণ্য বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে এই কোম্পানির উৎপাদন বিস্তৃত। বেক্সিমকোর প্রধান ও সবচেয়ে বড় খাত টেক্সটাইল, যা দেশের এবং রপ্তানির বাজারে নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য কটন ও পলিয়েস্টার মিশ্রিত পোশাক তৈরি করে।
গাজীপুরে রপ্তানিমুখী পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলো কার্যাদেশ পায়নি এমন কারণ দেখিয়ে বেক্সিমকো শিল্পগোষ্ঠী তাদের ১৫ পোশাক কারখানার প্রায় ৪০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে।
গত ১৯ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজীপুরে রপ্তানিমুখী পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলো কার্যাদেশ পায়নি এমন কারণ দেখিয়ে বেক্সিমকো শিল্পগোষ্ঠী তাদের ১৫ পোশাক কারখানার প্রায় ৪০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে।
গত ১৫ ডিসেম্বর জারি করা বিজ্ঞাপ্তিতে শিল্পগোষ্ঠীটির সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ছাঁটাই কার্যকরের কথা জানানো হয়। এতে আরও বলা হয়, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের কারখানায় রিপোর্ট করার প্রয়োজন নেই। কেননা, আগামী ৩০ জানুয়ারি আবার কারখানা খোলার সম্ভাব্য তারিখ পর্যন্ত সব ধরনের উৎপাদন কাজ বন্ধ থাকবে। ৪৫ দিনের ছাঁটাইয়ের সময়কালে কর্মীদের বেতন সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তিতে শ্রম আইনের উল্লেখ করা হয়েছে। এতে শ্রমিকদের মূল বেতনের অর্ধেক ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বেক্সিমকোর ফাইন্যান্স ও কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খুলতে না পারায় উৎপাদন চালানো যাচ্ছে না।’
বেক্সিমকোর বিবৃতি নিশ্চিত করেছে, তাঁদের কোনো কারখানা বন্ধ হয়নি এবং সবগুলোই নিরবচ্ছিন্নভাবে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে।

বেক্সিমকোর বন্ধ কারখানাগুলো চালুর দাবি

গার্মেন্টস বিভাগের সব কারখানা চালু করা, ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমতি প্রদান করা এবং কারখানা ও ব্যবসা চালু রেখে বকেয়া বেতন ও কোম্পানির দায়-দেনা পরিশোধের সুযোগ দেয়া এ তিন দাবি জানিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্মকর্তা- কর্মচারিরা।
মূলত, বেক্সিমকো গ্রুপ নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে থাকা ২৩ একর জমি বন্ধক রেখে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ চায়। গ্রুপটি এ ঋণ চায় ‘শুধু চার মাসের জন্য’, যা পেলে তারা কারখানাগুলো পরিচালনা এবং ধীরে ধীরে ব্যাংকের আগের দায় পরিশোধ করতে পারবে। এ লক্ষ্যে বছরে ৪০০ কোটি টাকা করে বকেয়া ঋণ পরিশোধের পরিকল্পনা সরকারের কাছে জমা দেয়া আছে। কিন্তু সরকার বা ব্যাংক কিছুই বলছে না।
বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) ঢাকার পল্টনে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘বেক্সিমকোর লে-অফকৃত সব কারখানার ব্যাংকিং সুবিধাসহ কারখানা খুলে দেওয়া’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবির কথা তুলে ধরা হয়। বেক্সিমকোর শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তারা এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে বক্তব্য দেন বেক্সিমকো ফ্যাশন লিমিটেডের প্রশাসন বিভাগের প্রধান সৈয়দ মো. এনাম উল্লাহ ও বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের প্রশাসন বিভাগের প্রধান আবদুল কাইয়ুম। এ সময় বেক্সিমকো গ্রুপের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমান বিদেশে রয়েছেন। ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান আছেন কারাগারে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওসমান কায়সার চৌধুরী। চেয়ারম্যান ও এমডির সঙ্গে কথা বলেই এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় বলে গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান। লে-অফ প্রত্যাহার করে তিনটি দাবির কথা জানানো হয়। এগুলো হচ্ছেÑ গার্মেন্টস বিভাগের সব কারখানা চালু করা, ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমতি প্রদান করা এবং কারখানা ও ব্যবসা চালু রেখে বকেয়া বেতন ও কোম্পানির দায়-দেনা পরিশোধের সুযোগ দেয়া।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বেক্সিমকোর ১৬টি কারখানা এখন লে-অফ বা বন্ধ। জানুয়ারি পর্যন্ত বেতন-মজুরি পাওয়া গেলেও ফেব্রুয়ারি থেকে পুরোপুরি সব বন্ধ হয়ে যাবে। এতে ৪২ হাজার মানুষ চাকরি হারাবেন, বেতন-মজুরিও আর পাওয়া হবে না। এই ৪২ হাজার মানুষের সঙ্গে বেক্সিমকো শিল্পপার্কের আশপাশের দোকানদার, অটোরিকশাচালক ও স্কুল-মাদ্রাসা মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষের রুটি-রুজি জড়িত। সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে মানবেতর জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে তাঁদের এবং তখন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার নতুন সংকটও তৈরি হতে পারে।
ঋণ আদায় করতে হলে প্রতিষ্ঠান চালু রাখাই উত্তম বিকল্প এবং প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বেক্সিমকোর কাছ থেকে ঋণ আদায় করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বক্তারা। বেক্সিমকোর ৪২ হাজার কর্মজীবীর মধ্যে প্রায় ২ হাজার প্রতিবন্ধী, শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এবং ৫ হাজারের মতো ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি রয়েছেন এ তথ্য উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, এশিয়া মহাদেশেরই একটি বড় শিল্প গ্রুপ বেক্সিমকো। এর গার্মেন্টস ডিভিশনই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মাসে প্রায় ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে দেশের রপ্তানি আয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করত।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমান সময়ের উপযোগী যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি আর দক্ষ জনবল নিয়ে তিল তিল করে গড়ে ওঠা আজকের বেক্সিমকোর পোশাক কারখানাগুলো মরিচা ধরার অপেক্ষায়। মাসে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ পিস গার্মেন্টস পণ্য তৈরির সক্ষমতা রয়েছে বেক্সিমকোর। আছে অত্যাধুনিক মেশিনে সজ্জিত প্রিন্টিং, এমব্রয়ডারি ও অ্যাকসেসরিজ তৈরির কারখানা। বিদেশি ক্রেতাদের প্রধান আকর্ষণ বেক্সিমকোর কারখানা, যেখানে কার্যাদেশ দিতে বিদেশিরা সব সময় তৎপর থাকেন। তুলা ও কেমিক্যাল ক্রয় ছাড়া গার্মেন্টস তৈরির অন্য কিছুই বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় না এই গ্রুপকে।

লাভজনক, সুবিধাজনক ও শ্রমঘন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে ১০ লাখ মানুষের মুখের আহার কেড়ে নিয়ে এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধির ধারা ব্যাহত করে বর্তমান জননন্দিত সরকার কী সুবিধা লাভ করছে, তা বেক্সিমকোর কর্মীদের জানা নেই বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ব্যক্তি দোষ করলে আইন অনুযায়ী প্রতিকার হবে। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এ জন্য শাস্তি পেতে পারেন না।

বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের প্রশাসন বিভাগের প্রধান আবদুল কাইয়ুম বলেন, সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে দায় পরিশোধের চাপ সৃষ্টি শুধু অমানবিকই নয়, অন্যায্যও। এই দায় বহন করার সক্ষমতা কোনো সরকারের বা ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কারখানা বন্ধ রাখার প্রক্রিয়া যতই প্রলম্বিত হবে, বেক্সিমকোর দায়ও তাতে বাড়তে থাকবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন ‘জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে আমরাও ছিলাম। সেই বিপ্লব যদি হয়ে থাকে বৈষম্য লাঘবের জন্য, তাহলে আমরা কেন বৈষম্যের শিকার হব?’

গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টে এক শুনানিতে বেক্সিমকো গ্রুপের দায়ের পরিমাণ তুলে ধরেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী মুনীরুজ্জামান। সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন, ১৬টি ব্যাংক ও সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বেক্সিমকো গ্রুপের ৭৮টি প্রতিষ্ঠানের দায়ের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ হিসাব ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের।

বেক্সিমকো গ্রুপ বাংলাদেশের একটি বৃহত্তম ব্যবসায়িক সংস্থা, যার বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কোম্পানি হলো: বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, বেক্সিমকো সিনথেটিকস, শাইনপুকুর সিরামিকস, বেক্সিমকো টেক্সটাইলস, বেক্সিমকো পাওয়ার এবং বেক্সিমকো পেট্রোলিয়াম।
বেক্সিমকো গ্রুপ এর অন্তর্ভুক্ত উল্লেখযোগ্য কোম্পানি:
বেক্সিমকো লিমিটেড:
এটি একটি বহুমাত্রিক কোম্পানি, যার বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে। বেক্সিমকো লিমিটেড একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানি এবং এটি বেক্সিমকো গ্রুপের মূল সংস্থা।
বেক্সিমকো ফার্মা:
এটি একটি ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি এবং বেক্সিমকো গ্রুপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বেক্সিমকো ফার্মা বিভিন্ন ধরণের ঔষধ তৈরি করে এবং এটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।
বেক্সিমকো সিনথেটিকস:
এটিও একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানি, যারা সিনথেটিক পণ্য তৈরি করে।
শাইনপুকুর সিরামিকস:
এই কোম্পানি সিরামিক সামগ্রী তৈরি করে এবং বেক্সিমকো গ্রুপের একটি অংশ।
বেক্সিমকো টেক্সটাইলস:
টেক্সটাইল এবং পোশাক শিল্পের সাথে যুক্ত একটি কোম্পানি।
বেক্সিমকো পাওয়ার:
বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ এর সাথে সম্পর্কিত একটি কোম্পানি।
বেক্সিমকো পেট্রোলিয়াম:
তেল এবং গ্যাস খাতে ব্যবসা করে।
এছাড়াও, বেক্সিমকো গ্রুপের আরও অনেক সহায়ক এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা বিভিন্ন খাতে ব্যবসা পরিচালনা করে।

অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান
দ্য বেক্সিমকো গ্রুপ
বেক্সিমকো জুট ডিভিশন
বেক্সিমকো ফার্মা
বেক্সিমকো সিনথেটিক্স লিমিটেড
বেক্সিমকো – টেক্সটাইল ্ এপারেল ডিভিশন
শাইনপুকুর সিরামিকস
বেক্সিমকো পেট্রোলিয়াম লিমিটেড
বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড
বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড
বেক্সিমকো – মেরিন ফুডস ডিভিশন
বেক্সিমকো – আইটি ডিভিশন
আইএফআইসি ব্যাংক
ইয়েলো
ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
আকাশ ডিটিএইচ
বেক্সিমকো – রিয়েল এস্টেট ডিভিশন
বেক্সিমকো কম্পিউটার লিমিটেড
বেক্সট্রেড লিমিটেড
বেক্সিমকো সিকিউরিটিজ লিমিটেড
বেক্সিমকো কমিউনিকেশন লিমিটেড (ডিটিএইচ)
ওয়েস্টিন হোটেলস (বাংলাদেশ)
শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাব
বেক্সিমকো ফুডস লিমিটেড
গিগা টেক
বেক্সিমকো ফিশারিজ লিমিটেড
বেক্সিমকো পোর্টস লিমিটেড
বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড
বেক্সিমকো পিপিই লিমিটেড
বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড

প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম:
১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত, বেক্সিমকো ফার্মা ১৯৮০ সাল থেকে ঔষধ উৎপাদন শুরু করে।
বৈশ্বিক স্বীকৃতি:
বেক্সিমকো ফার্মা এশিয়া প্যাসিফিকের সেরা ২০০ কোম্পানির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে, যা ফোর্বস ম্যাগাজিন কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।
কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন:
কোম্পানিটি বাংলাদেশে প্রথম মলনুপিরাভির (একটি ওরাল অ্যান্টি-কোভিড ওষুধ) উৎপাদন ও বিপণনকারী। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় রেমডেসিভিরের জেনেরিক সংস্করণ তৈরিতেও বেক্সিমকো ফার্মা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেডের ৫৪.৬% শেয়ার অধিগ্রহণ করে কোম্পানিটি।
বিভিন্ন ধরনের ঔষধ উৎপাদন:
বেক্সিমকো ফার্মা ৫০০টিরও বেশি ঔষধ উৎপাদন করে, যা বিভিন্ন থেরাপিউটিক বিভাগে বিস্তৃত।
অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান:
কোম্পানিটি বেক্সিমকো গ্রুপের একটি অংশ এবং আইএফআইসি ব্যাংক, ইয়েলো, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, বিডিনিউজ২৪.কম এর মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত।

ইতিহাস

কোম্পানিটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক পরে, ১৯৭২ সালে দুই ভাই এ.এস.এফ. রহমান এবং সালমান এফ রহমান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের পরিবার আগে পাটের ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে পাট কারখানা জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে মুক্ত বাজার সংস্কারের মাধ্যমে পরিবারটি তাদের অনেক ব্যবসা পুনরুদ্ধার করে।
১৯৭০-এর দশকের শুরু থেকে, বেক্সিমকো শিল্প ও ব্যবসায়িক খাতে অগ্রগামী হয়। বর্তমানে এটির ওষুধশিল্প, সিরামিক, নবায়নযোগ্য শক্তি, টেক্সটাইল, এলপিজি, খাদ্য ও পানীয়, স্যাটেলাইট থেকে হোম টেলিভিশন, পিপিই, মিডিয়া, আইসিটি, রিয়েল এস্টেট, আর্থিক পরিষেবা এবং ভ্রমণ ও পর্যটনসহ বিস্তৃত শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে।
২০০৫ সালে, বেক্সিমকো ফার্মা বাংলাদেশী কোম্পানি হিসেবে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের বিকল্প বিনিয়োগ বাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বেক্সিমকো পাকিস্তানের করাচিতে ইয়েলো পোশাকের ব্র্যান্ড চালু করার সাথে সাথে তার প্রথম বিদেশী খুচরা আউটলেটও খুলে। ইয়েলো এর পর থেকে বেশ কয়েকটি বাংলাদেশী এবং পাকিস্তানি শহরে বিস্তৃত হয়েছে। ২০০৯ সালে, শাইনপুকুর সিরামিক রাশিয়ার মস্কোতে একটি শোরুম খুলে। ২০১০ সালে, কোম্পানিটি আইএফআইসি ব্যাংক, জিএমজি এয়ারলাইনস, দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট সংবাদপত্র এবং ইউনিক হোটেল এবং রিসোর্টসহ বেশ কয়েকটি বড় বাংলাদেশী ব্যবসায় অংশীদারিত্ব অর্জন করে।
কোম্পানিটির আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে বলে মনে করা হয়। সালমান এফ রহমান আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত একজন সাংসদ ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ছিলেন।

প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তাগণ
এ এস এফ রহমান, চেয়ারম্যান
সালমান এফ রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান
শায়ান এফ রহমান, বোর্ড উপদেষ্টা
শাহরিয়ার রহমান, বোর্ড উপদেষ্টা
এবিএস রহমান, গ্রুপ ডিরেক্টর
ইকবাল আহমেদ, গ্রুপ ডিরেক্টর
সামি ওয়াদুদ, গ্রুপ ডিরেক্টর
আজমল কবির, গ্রুপ ডিরেক্টর
নাজমুল হাসান পাপন, গ্রুপ ডিরেক্টর এবং সিইও (ফার্মাসিউটিক্যালস)
সৈয়দ নাভেদ হোসেন, গ্রুপ ডিরেক্টর এবং সিইও (টেক্সটাইল)
ও কে চৌধুরী, গ্রুপ ডিরেক্টর এবং সিইও (পাওয়ার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং)
হুমায়ুন কবির এফসিএ, সিইও (সিরামিকস)
এম শামসুর রহমান, সিইও (মিডিয়া)
শাহ এ সারওয়ার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (আইএফআইসি ব্যাংক)
মৃণাল রায়, সিইও (পেট্রোলিয়াম)
এম আসাদ উল্লাহ এফসিএস, নির্বাহী পরিচালক ও কোম্পানি সচিব

বেক্সিমকোর শ্রমিক-কর্মচারীর
পাওনা পরিশোধ করল সরকার

বেক্সিমকো শিল্পপার্কের ১৪টি লে-অফ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধে ৫২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করেছে সরকার। ঋণ হিসেবে এই অর্থ দিয়েছে সরকার। বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওসমান কায়সার চৌধুরীর কাছে
৬ মার্চ বৃহস্পতিবার এ চেক হস্তান্তর করেন শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। আগামী ৯ মার্চ রোববার থেকে পর্যায়ক্রমে বেক্সিমকোর শ্রমিক-কর্মকর্তাদের পাওনা পরিশোধ করা হবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আজ বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়।
বেক্সিমকো শিল্পপার্কের ১৪টি লে-অফ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক রয়েছেন ৩১ হাজার ৬৭৯ জন, আর কর্মচারী ১ হাজার ৫৬৫ জন। ১৪টি প্রতিষ্ঠান গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। বন্ধ ঘোষণার আগের দিন গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বেক্সিমকো শিল্পপার্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ এই চেক হস্তান্তর করা হয়।
২৭ ফেব্রুয়ারির বৈঠক শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছিলেন, বেক্সিমকোর শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থের জোগান দেওয়া হবে। পাওনাবাবদ মোট অর্থের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ দেবে ৩২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বাকি ২০০ কোটি টাকা দেওয়া হবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে। সেই অনুযায়ী, পাওনা অর্থ আজ কোম্পানি কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করা হয়।
বেক্সিমকো গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গ্রেপ্তার হন সালমান এফ রহমান। ১৩ আগস্ট থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন। ২৯ আগস্ট সালমান এফ রহমান, তাঁর ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান, পুত্রবধূ শাজরেহ রহমানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠানটির ঋণপত্র বা এলসি সুবিধাও বন্ধ করে দেয়। এতে বিপাকে পড়ে বেক্সিমকো শিল্পপার্কের প্রতিষ্ঠানগুলো। কাঁচামালের সংকটে কারখানাগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর এসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকেরা বিক্ষোভ শুরু করেন। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়।
উপদেষ্টা কমিটি প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনা মেটানো হবে। পরে শেয়ার বিক্রিতে জটিলতা দেখা দিলে কমিটি সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। পরে সিদ্ধান্ত হয় সরকারের ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধ করা হবে। এর আগে অবশ্য বেক্সিমকো কর্তৃপক্ষ ১৪টি প্রতিষ্ঠান লে-অফ ঘোষণা ও শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করে। এই ১৪ প্রতিষ্ঠানে মোট শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার।
বেক্সিমকো গ্রুপের দেনা-পাওনাবিষয়ক সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গ্রুপটির কাছে জনতা ব্যাংকের ২৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ৪২৪ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৪২০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৯৮৭ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩১৫ কোটি, ইউসিবির ৩৩৩ কোটি, এবি ব্যাংকের ৯৩৮ কোটি, এক্সিম ব্যাংকের ৪৯৭ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৬১ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ৯৪ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের ৭৮ কোটি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিআইএফএফএলের ৮৭ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।
সম্প্রতি বেক্সিমকো শিল্পপার্কের আওতাধীন কোম্পানিগুলোকে দেয়া ঋণ ও ঋণের বিপরীতে জামানতের তথ্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিকে। কমিটি সূত্রে জানা গেছে, যথাযথ জামানত ছাড়াই বেক্সিমকো গ্রুপকে ঋণ দিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। গ্রুপটির ৩১ প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ব্যাংকঋণ ২৮ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। এই ঋণের বিপরীতে জমি, ভবন, যন্ত্রপাতি, শেয়ার, স্থায়ী আমানত (এফডিআর) মিলিয়ে বন্ধক রয়েছে ৪ হাজার ৯৩২ কোটি টাকার সম্পদ। সেই হিসাবে বন্ধক থাকা সম্পদ মোট ঋণের ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বেক্সিমকো যেসব কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছে, তার মধ্যে ১২টির কোনো অস্তিত্ব নেই। এই ১২ কোম্পানির নামে ঋণ রয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক অস্তিত্বহীন এসব কোম্পানিকে ঋণ দিয়েছে।

আরও খবর

Sponsered content